হাস্যকর আতঙ্ক! পত্রিকা খুললেই কয়েকদিন আগে মনে হতো যে দেশে ডেঙ্গু ছাড়া আর কিছু নাই। কোনো মানুষ নাই জন নাই কিছু নাই আছে শুধু ডেঙ্গু।
অথচ ডেঙ্গুতে যদি আমরা দেখি ২০২০ সালে মৃত্যু হয়েছে সাত জনের, ২০২১ সালে ১০৫ জনের, ২০২২ সালে ২৮১ জনের। এবং ২০২৩ সালে এই পর্যন্ত (২৮ জুলাই ২০২৩) মারা গেছেন ২২৯ জন। যারা মারা গেছেন প্রত্যেকের প্রতি আমাদের সমবেদনা রয়েছে সমমর্মিতা রয়েছে।
মোট হিসাব করলে ৬২২ জন সাড়ে তিন বছরের মৃত্যু হয়েছে ।
আর ধূমপানে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৪৫০ জন সারা পৃথিবীতে না কিন্তু আমাদের দেশে।
মশার আক্রমণে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন সাড়ে তিন বছরে ৬০৮ জন । কারণ ডেঙ্গুর যে ভাইরাস এটা বহন করে মশা। আর ধূমপান ৪৫০ জন প্রত্যেকদিন এবং প্রতি বছর মৃতের সংখ্যা এক লক্ষ ৬১ হাজার জন।
আর করোনাতে তিন বছরে মারা গেছে ২৯ হাজার আমাদের দেশে। করোনাতে ২৯ হাজার আর ডেঙ্গুতে ৪৭৬ জন।
মানে ডেঙ্গুর যে হেডিং সব দেখলে মনে হয় যে, সারাদেশে ডেঙ্গু ছাড়া আর কেউ নাই। সেই সোনাবানের পুঁথির মতো। – লাখে লাখে ফৌজ মরে কাতারে কাতার, শুমার করিয়া দেখি সাড়ে সাত হাজার। শুমার মানে হচ্ছে গণনা ।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ :
ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য সব সাধারণ জ্বরের (যেমন, টাইফয়েড) সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরের মূল পার্থক্য হলো প্রথমদিন থেকেই জ্বর অনেক বেশি থাকে (১০২-১০৫ ডিগ্রি) ফারেনহাইট। জ্বরের সঙ্গে মাংসপেশি ব্যথা, শরীরের গিঁটে ব্যথা, চোখের পেছনে ও মাথায় ব্যথা, শারীরিক অবসাদ, বমি আর শরীরের কিছু অংশে বিশেষত চামড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধা—এ লক্ষণগুলো দেখা যায়।
ডেঙ্গু জ্বর কয়েক ধরনের :
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। সেইসাথে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা থাকে। বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি এবং মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে, মনে হয় বুঝি হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’।
জ্বর হওয়ার ৪র্থ বা ৫ম দিনে সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ। যা অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমিও হতে পারে। এসময় রোগীর মধ্যে ক্লান্তিবোধ এবং খাওয়ায় অরুচি দেখা যায়। সাধারণত ৪/৫ দিন পর জ্বর থেকে রোগী সেরে ওঠেন তবে কারো কারো ক্ষেত্রে সেরে ওঠার ২/৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফিভার’ বলে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ডেঙ্গুর জটিল অবস্থা। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি এসময় শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত হয়। যেমন : চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সঙ্গে, রক্তবমি, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে, নারীদের অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্তপাত ইত্যাদি।
এই রোগের বেলায় কখনো কখনো বুকে ও পেটে পানি চলে আসে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস ও কিডনি আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর নামক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হলো ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সাথে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো : রক্তচাপ হঠাৎ কমে যায়। নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়। হাত পা ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রস্রাব কমে যায়। এ-ক্ষেত্রে হঠাৎ করে রোগী অচেতন হয়ে যেতে পারেন। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
চিকিৎসা :
চিকিৎসকরা বলে থাকেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যান। এমনকি কোনো চিকিৎসা না করালেও। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে, যাতে ডেঙ্গু জ্বর-পরবর্তী কোনো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি না হয়। সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
- যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। খেতে না পারলে শিরাপথে স্যালাইন প্রয়োগ করার দরকার হতে পারে।
- জ্বর কমানোর জন্যে শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথার ওষুধ সেবন না করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। কেননা এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে।
- জ্বর কমানোর জন্যে ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছতে হবে।
- নিজেরা অনুমান করে বা ডাক্তার নন এমন কোনো ব্যক্তির পরামর্শে কোনো চিকিৎসা নেয়া একদমই অনুচিত। ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার দরকার। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বুঝে পরামর্শ দেবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ডেঙ্গু এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন টেস্ট করলে এক থেকে দুদিনেই বোঝা যায়। সুতরাং কারো সন্দেহ হলে এই পরীক্ষাটা সহজেই করে নিতে পারে। কারো এটি অবহেলা করা উচিত নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেয়ার ৪ থেকে ৫ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগে রক্তের সিবিসি, প্লাটিলেট টেস্ট করা উচিত নয়। যদি দুই দিনের জ্বরে টেস্ট করেন তো রিপোর্ট স্বাভাবিক আসতে পারে। তাতে রোগী মনে করেন, আমি তো ভালোই আছি। চিকিৎসক যদি খেয়াল না করেন, তিনি মনে করতে পারেন সবকিছু ঠিক রয়েছে। আসলে কিন্তু তা নয়। ৪/৫ দিন পর প্লাটিলেট কমে। সে-সময় টেস্ট করলে রোগী বুঝবেন প্লাটিলেট কমছে কিনা। ৫ দিন পর ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমতে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড বলে। এই অবস্থাটি কিন্তু জটিল। কারণ জ্বর চলে গেল এবং রোগী মনে করলেন, আমি তো ভালো আছি। যত অঘটন ঘটে, সেগুলো কিন্তু এসময়।’
প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনো আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন : নাক বা দাঁতের মাড়িতে রক্তপাত, প্রস্রাব অথবা মলের সঙ্গে রক্তপাত, ক্ষতস্থান না শুকানো এবং সেখান থেকে রক্তক্ষরণ, মাত্রাতিরিক্ত র্যাশ ইত্যাদি প্লাটিলেট কমে যাওয়ার উপসর্গ। এসব উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই হাসপাতালে নেয়া উচিত।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আ ফ ম হেলালউদ্দিন গণমাধ্যমে বলেন, ‘অনেক বমি হওয়া ও বমির জন্যে কিছু খেতে না পারা, অস্থিরতা ও অস্বাভাবিক আচরণ, তীব্র পেটব্যথা ইত্যাদির মতো উপসর্গ দেখা গেলে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। এ-ছাড়া শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, বয়োবৃদ্ধ এবং ডায়াবেটিস রোগ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ রয়েছে—এমন রোগীদের শুরু থেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হতে পারে। অনেকেই দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে এর তীব্রতা বেশি। পরে জ্বর সারতে না সারতেই অনেকে দ্রুত ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের জটিলতায় পড়ছেন। তাই জ্বর সেরে যাওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে।’
প্লাটিলেট যদি ৫ হাজারের কম হয় তখন ব্রেন, কিডনি, হার্টের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে অনেকটাই আশার কথা যে, এমন রোগীর সংখ্যা খুবই সামান্য। বারডেম হাসপাতালের মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমউদ্দিন গণমাধ্যমকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমার সঙ্গে অন্য অনেক (অন্তত আরো ১১টি) কারণে রক্তক্ষরণ হয়। বরং প্রথম থেকে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে এবং সঠিক পরিমাপে তরল পদার্থ রোগীকে দিতে পারলে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা বাসাতেই সম্ভব। তাছাড়া রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিতে পারলে ডেঙ্গু সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়।’
সংগৃহীতঃ ওয়েব সাইট থেকে