জুয়া বা ক্যাসিনোতে যারা খেলে তারা সাধারণত জেতে না, জেতে আয়োজকরা। অথচ জুয়াড়িরা বুঝতে পারে না এর ফাঁক-ফোকর। নেশায় বুঁদ হয়ে বারবার ডুবে যায় জুয়ার আসরে। আর জুয়াড়িদের নিয়ে আজীবন খেলে যায় আয়োজকরা। সব হারিয়ে দিশেহারা জুয়াড়িদের জীবনে নেমে আসে করুণ পরিণতি। গত ২ অক্টোবর ২০১৯ প্রথম আলোতে 'ক্যাসিনোয় ভাগ্যের খেলার আড়ালে যা চলে' শিরোনামে একটি লেখায় বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেন প্রকৌশলী ও লেখক মোস্তফা তানিম। লেখাটি তুলে ধরা হলো-
ক্যাসিনোতে ‘বিগেনার্স লাক’ বলে একটা কথা আছে। এর মানে হচ্ছে, প্রথমবার যে যায়, সে জেতে। কিন্তু সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, তারপর লোভে লোভে সেই বিজয়ীরা আবার ক্যাসিনোতে গিয়ে হাজির হয় এবং হারতে থাকে। দীর্ঘ মেয়াদে দেখা যায়, সব খেলোয়াড় মোটের ওপর হেরেছে। সেই হেরে যাওয়া টাকাগুলো গিয়েছে ক্যাসিনো মালিকের বা যে কোম্পানি ক্যাসিনো চালায়, তাদের লাভের অ্যাকাউন্টে।
বিগেনার্স লাক না থাকলে কেউ ক্যাসিনোতে গিয়ে প্রচুর টাকা এবং সময় ব্যয় করে খেলত না। ‘মার্ফিস ল’এর মতোই ‘বিগেনার্স লাক’ একটি অবৈজ্ঞানিক কিন্তু ঘটমান ব্যাপার। ক্যাসিনো খেলার স্থানে দেয়ালে, স্লট মেশিনে, কোথাও কোনো ঘড়ি নেই। কোথাও তারা কোনো সময় দেখায় না। কারণ, আপনার হয়তো পাঁচটায় একটা কাজ আছে। ঘড়ি সব সময় চোখের সামনে থাকলে আপনি পাঁচটার আগেই উঠে যাবেন। খেলোয়াড় থাকলেই লাভ। যতই খেলুক না কেন, দিন শেষে সে অবশ্যই হারবে।
ক্যাসিনোতে হারার থেকে জেতা আরও খারাপ, আরও বড় হার। কারণ, মাথার মধ্যে যে ‘ডোপামিন’ নিঃসরণ হয়, জ্যাকপটের ঝনৎকার শব্দ যে বিপুল উত্তেজনা দিয়ে যায়, তার স্বাদ নিতে সেই বিজয়ী আবার আসবে। আরও বড় দানে খেলবে এবং আগের জেতাসহ তার অস্থাবর-আস্থাবর সব হারাবে। যে একবার এর মধ্যে মাথা ঢুকিয়েছে, সে বারবার যায়। হারলে যায় সেই হারা টাকাগুলো তুলতে। জিতলে যায় আরও বড় দান জিততে।
ফোর্বস ম্যাগাজিন ‘সার্টিফায়েড ফিন্যানশিয়াল প্ল্যানার বোর্ড অব স্ট্যান্ডার্ডস’–এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে, যারা বড় বড় লটারি জেতে, এমনকি পঞ্চাশ/এক শ মিলিয়ন ডলার, তাদের এক–তৃতীয়াংশই কয়েক বছরের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে যায়। সেটা অবশ্য অন্য কারণে, আকাশ থেকে পড়া টাকা মানুষ দেদার খরচ করতে শুরু করে। টাকার গন্ধে অনেক ইয়ার-বন্ধু, খয়ের খাঁ জুটে যায়। খরচের আর লোক দেখানো বিলাসিতার অসংখ্য পথ খুলে যায়। কাউকে না–ও বলা যায় না। কিন্তু এই হঠাৎ কপাল খুলে যাওয়া মানুষদের মাথায় আয়-উপার্জনের চিন্তা আসে না। দেখা গেছে ‘মানি ম্যানেজম্যান্ট’–এর দক্ষতা ছাড়া হঠাৎ করে কারণ ছাড়াই বড় অঙ্কের অর্থ দিলেও তা থাকে না। এমনকি যা ছিল তা–ও চলে যায়।
যে মেশিনগুলোতে পয়সা ঢুকিয়ে হাতল টানলেই মনমাতানো শব্দে ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে, শেষে জিতলে ভীষণ ঝনঝন শব্দ করে পয়সা পড়তে থাকে, সেগুলোর ভেতরে সফটওয়্যার দিয়ে ‘ভাগ্য’ নির্ধারণ করে আছে। তাকে বলে ‘পে ব্যাক’ বা ‘পে আউট’। পে আউট ৯০ শতাংশ হলে সেই মেশিনে যত টাকা ঢুকবে, বছর শেষে (দীর্ঘ সময়ে) তার ১০ শতাংশ ক্যাসিনোর থাকবে, ৯০ শতাংশ বিভিন্ন খেলোয়াড় বিভিন্ন সময় পেয়ে যাবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে কী? একজন ধনী জুয়াড়ি যদি ধরা যাক এক বছর দিন–রাত একটানা সেই মেশিনে এক কোটি টাকা খেলে, মেশিন তাকে ৯০ লাখ টাকা ফেরত দেবে। ১০ লাখ রেখে দেবে। তার মানে যা–ই করুন না কেন, দীর্ঘ মেয়াদে হার হবে।
গাণিতিকভাবে এই বিষয়টা অবশ্যম্ভাবী। পূর্বনির্ধারিত। আবার খেলোয়াড়ের হঠাৎ হঠাৎ ছোট-বড় জ্যাকপট পেয়ে যাওয়াও কিন্তু পূর্বনির্ধারিত। খেলোয়াড় ভাবছে, আজ কী ভাগ্য আমার! যেই প্রোগ্রামার সেটা প্রোগ্রাম করেছে, সে বা তারা আবার ভাবছে, কী বোকা মানুষ এরা! ধরুন সহজ একটা অ্যালগরিদম, ৭০০ বারের বার যখন ঘুরবে, তখন তিনটা লাল রঙের ‘সাত’ একই লাইনে এসে দেখা দেবে। তার পুরস্কার হলো ৫০০ পয়েন্ট, যেটা ধরুন ১২৫ ডলারের সমতুল্য। তারপরের ৩০ বার তেমন কিছুই মেলানো হবে না। মাঝেমধ্যে দু-চার ডলারের ‘পে আউট’ হবে। তারপরে ৭৩১ বারের বার মিলবে তিনটি ‘জ্যাকপট’, পাওয়া যাবে ৪০০০ পয়েন্ট পুরস্কার, ১০০০ ডলার।
ঘটনাটা আশ্চর্যজনক। ধরুন, ক্যাসিনোতে রাম এসেই মেশিনে এক ডলার ঢুকিয়ে হ্যান্ডেল টানল। লেগে গেল তিনটা লাল ‘সাত’। খুশিতে ডগমগ হয়ে সে ১২৫ ডলার নিয়ে অন্য মেশিনে গেল। তারপর এল শ্যাম, সে প্রায় ৩০ বার খেলল। তেমন কিছু পেল না। ‘আজকে লাকটা ভালো না, এই মেশিনটা কুফা’ বলে সে পকেট থেকে আরও টাকা বের করতে করতে অন্যদিকে চলে গেল। এরপর এল যদু। এবার কিন্তু সেই ৭৩১ বার। সে বিশাল জ্যাকপট পেয়ে গেল। ভীষণভাবে লাইট জ্বলা-নেভা করছে, অপূর্ব টংকার ধ্বনি বেরোচ্ছে, আশপাশের সবাই তার দিকে (আসলে তার সৌভাগ্যের দিকে) তাকাচ্ছে। যদু খুশিতে আটখানা। ভাবছে, ‘আজকে ভাগ্যটা খুবই ভালো।’
তাহলে পূর্বনির্ধারিত কোনো ব্যাপার, সেটা অজানা থাকলেই কি আমরা তাকে ভাগ্য বলে অভিহিত করি? যেমন ঝড় এগিয়ে আসছে। অনেক ওপর থেকে স্যাটেলাইট দিয়ে দেখলে সেটা কোন দিকে কত বেগে যাচ্ছে, কোথায় কখন আঘাত হানতে পারে, প্রায় পরিষ্কার বোঝা যাবে। ভূমিতে যে মানুষটি কোথায় কী চলছে জানে না, তার মনে হবে হঠাৎ করেই ঝড় এসে জীবন লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল!
রুলেতেও ‘পে আউট ’ নির্ধারিত। সেটা আবার প্রোগ্রামার দিয়ে নয়, প্রাকৃতিকভাবেই, গাণিতিক নিয়মে। তারা ৩৮টা বেট নেয়, কিন্তু পে আউট করে ৩৬টার। যেই বল বিয়ারিংয়ের ওপর এই রুলেতে মেশিন ঘোরে, সেটা অ্যারোপ্লেনে যা ব্যবহার করা হয় তার সমমানের। বহু খেলা বানিয়ে রেখেছে। ক্র্যাপ আছে, দূর থেকে বড় বড় ছক্কার মতো গুটি ছুড়ে মারছে। সেটা একধরনের লুডুই বলা যায়। তারপর তাসের খেলা, ব্ল্যাক জ্যাক। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্ল্যাকজ্যাকেই ‘পে আউট’ সবচেয়ে বেশি।
প্রতিটা খেলার মধ্যে ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল প্রবাবিলিটি’ আছে। গণিতের বড় বড় পণ্ডিতকে দিয়ে তারা সম্ভাবনার তত্ত্ব ব্যবহার করে আগেই নিশ্ছিদ্র লাভের ব্যবস্থা করে রেখেছে। কোনো ‘জিনিয়াস’ জুয়াড়ি এসে যেন তাদের অ্যালগরিদমের ফাঁক দিয়ে সব টাকা জিতে চলে না যায়।
প্রবাবিলিটি একটা অদ্ভুত বিজ্ঞান। ‘ম্যাক্রো’ লেভেলে নিখুঁতভাবে প্রবাবিলিটি কাজ করছে। যেমন একটি পয়সা ওপরে ছুড়ে দিলে পড়ার পর তার কোন দিকটা দেখা যাবে, সেটা কেউ বলতে পারে না। অথচ সেই পয়সাটি যদি এক লাখবার (কথার কথা, অসংখ্য বার) এভাবে ছুড়ে হিসাব রাখা যায়, তাহলে দেখা যাবে ঠিক অর্ধেকসংখ্যক ‘হেড’, অর্ধেকসংখ্যক ‘টেইল’ এসেছে। ‘প্রবাবিলিটির’ এই ম্যাক্রো ব্যাপারটা দিয়ে অনেক কিছুই হচ্ছে। ভোটে কে জিতবে, পিউ রিসার্চ কয়েক দিন আগেই তা বেশ নির্ভুলভাবে বলে দিচ্ছে। একটা নতুন পারফিউম এক বছরে কতগুলো বিক্রি হতে পারে, তার ‘ফোরকাস্ট’ হচ্ছে। এমনকি লেবার ডে তে আমেরিকায় কতগুলো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে, প্রায় নিখুঁতভাবে তারও ‘ফোরকাস্ট’ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
একটি মানুষের কাছে যেটা অনিশ্চিত, ভাগ্য, একটি ক্যাসিনোর কাছে তা সুনিশ্চিত এবং অঙ্ক ও মনস্তত্ত্বের ফাঁদ। যারা এই সব খেলা খেলে, তাদের মধ্যে অদ্ভুত কিছু ভুল ধারণা তৈরি হয়। তার মধ্যে একটি প্রধান ধারণা হলো, এমন কিছু একটা সমীকরণ বের করে ফেলা, যেভাবে খেললে নির্ঘাত জিততে পারা যাবে। কম্পিউটার সিস্টেমকে হ্যাক করার মতো। সেই পদ্ধতিটি পৃথিবীর আর কারও মাথায় আসেনি। আবিষ্কর্তা উত্তেজনার সঙ্গে ভাবছে, সে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাবে। এই সব আবিষ্কর্তা অবশ্য ভুল-শুদ্ধ বোঝার আগে নিজেরাই সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। আরেকটা ধারণা, সেদিনের মতো যদি একটা বড় দান জিতে যাই! অথবা যদুর মতো জিতে গেলে সব ক্ষতি পুষিয়ে যাবে, তারপর আর জীবনেও খেলব না। তীরে এসে তরি ডুববে নাকি? এত লস মেনে নিয়ে এদের (ক্যাসিনোকে) ছেড়ে দেওয়া যায়? তাই আবার আসা হয়, বসা হয় খেলতে।
রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কি এমন জুয়াড়ি ছিলেন। এ কারণে তাকে বহুবার বিপর্যস্ত হতে হয়েছে। ‘জুয়াড়ি’ নামে একটি উপন্যাসও তিনি লিখেছেন। সেটা লিখে তিনি ধারের কিছু টাকাও নাকি শোধ করেছিলেন। তার সেই বইতে, ক্যাসিনোতে গিয়ে একজন জুয়াড়ির ভেতরে যে আশার আলো জ্বলে ওঠে, গভীর উত্তেজনার ঝলক শুরু হয় এবং কীভাবে সে তার জালে আটকা পড়ে যায়, সেটার নিখুঁত সুন্দর বর্ণনা দেওয়া আছে।
অনলাইন গেমিং নিয়ে আরও ১০ গুণ সাবধান। এতক্ষণ যা বললাম তা হলো ‘সৎ’ ক্যাসিনোর কথা। যেগুলো আমেরিকায় সরকারিভাবে রেগুলেটেড। অডিট হয়, জবাবদিহি আছে। কিন্তু আপনার টাকা স্রেফ দিনদুপুরে ডাকাতির মতো করে রেখে দেওয়ার বহু ব্যবস্থা অনলাইনে আছে। খুব সাবধান, বিশেষ করে কিশোর এবং তরুণদের বেশি সাবধান থাকা উচিত।
সূত্র: প্রথম আলো (২ অক্টোবর ২০১৯)